জোয়ার ভাঁটা

জোয়ার ভাঁটা
-চিন্ময় মহান্তী

 

কালাচাঁদ পৃষ্ঠদেশে পুস্তকের থলেটি লইয়া তাহার কাকার সহিত পাঠশালা হইতে আসিতেছিল । একটি লাল মাটির নুড়ি তাহার পদাঘাতে গড়াইতে গড়াইতে আসিতেছিল । তাহার কাকা তাহাকে বারংবার বলিতেছিলেন , ” একটু তাড়াতাড়ি চল বাবা । ” কিন্তু কালাচাঁদের , কাকার কথার প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ ছিল না । সে অভ্যাসবশতঃ সেই নুড়িটাকে পদাঘাত হইতে অব্যাহতি দান করিতে বিশেষ উৎসুক হইতেছিল না ।

কাকার সহিত যখন কালাচাঁদ ঘরে ঢুকিল দেখিল উঠানের মধ্যখানটিতে অনেকগুলি মহিলা জমায়েত হইয়া কিছু একটা ঘিরিয়া রাখিয়াছে । তাহার পিতা অদূরে বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়া মুহ্যমান হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন । রাতুল কাকা কয়েকটা খড়ের আঁটি লইয়া বুন্দি পাকাইতেছেন । কালাচাঁদ উৎসুক হইয়া গ্রাম্য মহিলাদের ভিড় সরাইয়া দেখিল , একটা সাদা ধুতি মুখ অবধি ঢাকিয়া কেহ যেন ঘুমাইতেছে । সে সেই ঘুমন্ত মানুষটির নিকট গিয়া তাহার মুখের ঢাকা সরাইতেই দেখিল তাহার মাতা তাহাকে ছাড়িয়া চিরনিদ্রামগ্ন হইয়াছেন । কালাচাঁদ এই দৃশ্য দেখিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল । দীর্ঘকাল রোগ শয্যায় শায়িত থাকিয়া তাহার মাতা অদ্য পরলোক যাত্রা করিয়াছেন । কালাচাঁদ কাঁদিতে কাঁদিতে পিতার নিকট আসিয়া , তাহার মাতার মৃত্যুর জন্য পিতাকে দায়ী করিতে লাগিল । অর্থের অকুলান জনিত কারনে তিনি যে স্ত্রীর সুচিকিৎসা করাইতে পারেন নাই ,তাহা কিরূপে সদ্য মাতৃহারা এই সন্তানকে বুঝাইবেন তাহা স্থির করিতে ব্যর্থ হইয়া অবনত মস্তকে পুত্র কর্তৃক আরোপিত দোষারোপ হজম করিতে লাগিলেন । এমতসময় কালাচাঁদের কাকা মহিম চাটুয্যে আসিয়া তাহাকে বলিলেন , ” বাবা দোষারোপ করার সময় এখন নয় । তোমার মায়ের সদগতি করতে হবে , চল । ” কাকার কথামত সে তাহার মাতার নিকটে গেল । মহিম চাটুয্যে একটা ধুতি লইয়া আসিয়া তাহাকে পরাইলেন । পাড়ার যুবক রীতেশ আসিয়া বলিল , ” মহিম খুড়ো , শ্মশানে কাঠ পৌঁছানো হয়েছে । ” মহিম খুড়ো তাহার কথার উত্তরে বলিলেন , ” আচ্ছা , সবাই মিলে চল তাহলে । ” রাতুল খুড়ো বুন্দিটি কালাচাঁদের হাতে দিয়া বলিলেন , ” বাবা , এটিতে আগুন দাও । ” কালাচাঁদ তাহাতে অগ্নি সংযোগ করিল । সকলেই ‘ হরিবোল বোলহরি ‘ বলিয়া হরিধ্বনি সহযোগে কালাচাঁদের মাতাকে লইয়া শ্মশান অভিমুখী হইল । কালচাঁদের পিতা চন্দ্রকান্ত বারান্দার সেই খুঁটিটিতে ঠেস দিয়া দেখিলেন তাহার সহধর্মিনী তাহাকে ছাড়িয়া স্বর্ন রথে আরোহন করিয়া স্বর্গে যাইতেছেন।

শ্মশানে আসিয়া কালাচাঁদের মাতাকে চিতার উপর উপুড় করিয়া শুয়াইয়া দেওয়া হইল । পুরোহিত তাহার যথাবিহিত কর্ম সমাপন করিয়া কালাচাঁদকে বলিলেন , ” বাবা এবার মুখাগ্নি করো । তারপর জলে ডুব দিয়ে মায়ের দিকে না তাকিয়ে দূরে গিয়ে বসো । ” কালাচাঁদ হাতে করিয়া কুঁচি কাঠি দ্বারা নির্মিত অগ্নি শলাকাটি মাতার মুখের সম্মুখে লইয়া গিয়া ফিরাইয়া লইল । তাহার চক্ষু বিদীর্ন করিয়া অশ্রু আসিয়া কোমল চিবুক বহিয়া ভূমে পতিত হইতে লাগিল । ইহা দেখিয়া তাহার কাকা তাহাকে বক্ষে জড়াইয়া বলিলেন , ” বাবা সবাইকে একদিন এই ভবের মায়া ফেলে যেতে হয় । ” কাকার এই তত্ত্বে কালাচাঁদের অশ্রু বিন্দুমাত্র কমিল না । সে বারংবার বলিতে লাগিল , ” আমি আমার মাকে পোড়াতে পারবো না । ” পুরোহিত বলিলেন, ” বাবা , তুমি মুখাগ্নি না করলে যে তোমার মায়ের সদগতি হবে না । ” কালাচাঁদ পুরোহিতের কথা শুনিয়া কি ভাবিল বলিতে পারিনা । তাহার মাতার মুখাগ্নি করিয়া জলে ডুব দিয়া উঠিয়া গিয়া , দূরে চিতার দিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিল । পুরোহিতের বিধান মান্য করিয়া সে তাহার মাতার স্বর্গ গমন দেখিতে পাইল না । শিশু মনে মাতার স্বর্গারোহণের একটি কাল্পনিক চিত্র আঁকিতে লাগিল । যেখানে সে দেখিল স্বর্গ হইতে একটি স্বর্ন রথ নামিয়া আসিল , তাহাকে দুইটি পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে । তাহার মাতা সেই রথে বসিয়া রহিয়াছেন ।
শবদেহ পোড়ানো শেষ হইতেই কালাচাঁদের কাকা তাহার নিকটে আসিয়া দক্ষিণ স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন , ” চল বাবা , বাড়ি চল । ” কালাচাঁদ কাকার হাত ধরিয়া গৃহ অভিমুখী হইল।

পুর্বোক্ত ঘটনার পর দীর্ঘ দুই বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে । কালাচাঁদের পিতা চন্দ্রকান্ত আজ সাজিয়া গুজিয়া রাসের মেলা দেখিতে যাইতেছেন । সাজা বলিতে একখানা সাদা পাঞ্জাবি ও একটি নীল রঙা জিন্স প্যান্ট পরিয়া , টেরি কাটিয়া গায়ে দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত রজনীগন্ধা সেন্ট ঢালিলেন । তাহাকে দেখিয়া বুঝিতে পারা কঠিন যে তাহার পত্নী গতা হইয়াছেন । উঠানে কালাচাঁদ সুখী গাভীর দুই মাসের বাছুরটিকে ঘোড়া বানাইয়া খেলিতেছিল । চন্দ্রকান্ত উঠানে আসিতেই তাহাকে দেখিয়া সে বলিল , ” বাবা , কোথায় যাবে ? ” পুত্রের কথায় কোনো উত্তর না করিয়া চন্দ্রকান্ত বাহির হইয়া গেলেন । কালাচাঁদ পিতার যাইবার পানে চাহিয়া রহিল। এই দৃশ্য দূর হইতে তাহার মাতার সখী পার্শ্ববর্তী গৃহের বধূ অনু লক্ষ্য করিয়াছিলেন । তিনি তাহার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন , ” চল বাবা , ক্ষীর বানিয়েছি , খাবি চল । ” কাকিমার কথা শুনিয়া ক্ষীরের প্রতি লোভ বশত কালাচাঁদ তৎক্ষণাতের জন্য পিতার কথা ভুলিল ।

রাসের মেলায় ঘুরিতে ঘুরিতে এক সুন্দরী রমনীকে দেখিয়া চন্দ্রকান্ত বিমোহিত হইলেন । তিনি তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে ঘুরিতে লাগিলেন। দীর্ঘক্ষন পর রমনী ইহা লক্ষ্য করিয়া সরাসরি তাহাকে বলিলেন , ” আপনি পিছু নিয়েছেন কেন ? ” চন্দ্রকান্ত নিশ্চুপ রহিলেন । রমনীর সখী কানে কানে বলিল , ” বুঝ্ছিস না , তোর রূপে পাগল হয়ে গেছে , তুইও তো স্বামী পরিত্যক্তা , পুরুষটি দেখতে তো ভালোই , যদি ……। ” দীর্ঘক্ষন চুপ থাকিয়া চন্দ্রকান্ত রমনীকে উদ্যেশ্য করিয়া বলিলেন , ” আপনার নাম কি ? ” রমনী বলিলেন , ” সুকন্যা ” । উহাদের মধ্যে বাক্যালাপ শুরু হইয়াছে দেখিয়া সুকন্যার সখী অনতিদূরে সরিয়া গেলেন । গল্প প্রসঙ্গে উভয়ে উভয়ের জীবনের অতীত বলিতে লাগিলেন । হঠাৎ করিয়া সুকন্যা বলিয়া বসিলেন , ” আমাকে বিয়ে করবে চন্দ্র ? ” চন্দ্রকান্ত হইতে এতো সহজেই তিনি সুকন্যার নিকট চন্দ্র হইয়া উঠিবেন তাহা কল্পনাও করেন নাই । তিনি বলিলেন , ” তোমার ফোন নম্বর দাও , পরে ফোনে বলবো । ” সুকন্যা তাহার ফোন নম্বর বলিতে লাগিলেন । চন্দ্রকান্ত আপনার সেলফোনটিতে তাহা টুকিয়া লইলেন । বর্তমান এন্ড্রয়েড ফোনের যুগে তাহার মান্ধাতা আমলের কাতুমার্কা সেল ফোনটা সুকন্যার নিকট বাহির করিতে কুন্ঠা বোধ হইতেছিল , প্রেমের নিকট সেই কুন্ঠা হার মানিয়া গেল ।
সন্ধ্যা নামিয়া আসিল । মেলার ভিড় কমিতে লাগিল । উহারাও উভয়ে উভয়ের প্রতি অদ্যকার মত শেষ প্রেমদৃষ্টি বিনিময় করিয়া লইলেন।

চন্দ্রকান্ত যখন ফিরিয়া আসিলেন ,দেখিলেন কালাচাঁদ খাটিয়ায় শুইয়া অঘোরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তিনি মধ্যাহ্নের অবশিষ্ট ভাত একটি স্টিলের সানকিতে বাড়িয়া খাইতে বসিলেন । এমতসময় তাহার ফোনটি বাজিয়া উঠিল , ফোন ধরিতেই অপর প্রান্ত হইতে একটি নারীকণ্ঠ বলিল , ” চন্দ্র বাড়ি পৌঁছেছ ? ” চন্দ্রকান্ত বলিলেন , ” খেতে বসেছি । ভেবে কাল তোমাকে বলবো । ” ” আচ্ছা ” বলিয়া সুকন্যা ফোন কাটিয়া দিলেন । চন্দ্র খাওয়া শেষ করিয়া , এঁটো বাসন তুলিয়া রাখিয়া পুত্রের পাশের একটি খাটিয়ায় শুইলেন।

সুকন্যার সহিত চন্দ্রের প্রেম উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে লাগিল । পুত্রকে তিনি বিষ নজরে দেখিতে লাগিলেন । উঠিতে বসিতে কালাচাঁদ তাহার পিতার অত্যাচারের শিকার হইতে লাগিল । একদিন অপরাহ্নে কালাচাঁদ সুখী গাভীকে খড় দিতে ভুলিয়া গিয়াছিল । চন্দ্রকান্ত কোথায় বাহির হইয়াছিলেন বলিতে পারিনা , ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন সুখীর সম্মুখের ঝুড়িটি খালি, একটিও খড় নাই । ইহা দেখিয়া পুত্রের উপর যারপরনাই ক্রুদ্ধ হইয়া তিনি একটি বাসের কঞ্চি কুড়াইয়া তাহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন । কালাচাঁদের তীব্র কান্না শুনিয়া তাহার কাকা মহিম ছুটিয়া আসিলেন । তিনি চন্দ্রকান্তকে বলিলেন, ” ছিঃ চন্দ্র, দুধের বাছাকে মারছিস । ” চন্দ্রকান্ত তাহার ভ্রাতার প্রতি একটি তীব্র অশ্রাব্য বাক্যবান প্রয়োগ করিয়া বলিলেন , ” আমার ছেলে না তোর ছেলে , দরদ উথলে উঠছে । দেখেতো মনে হচ্ছে তুই ওর বাবা । ” মহিম আর কোনো বাক্যব্যয় না করিয়া আপনার ঘরে চলিয়া গেলেন । তিনি ভাবিলেন পৃথক হাঁড়ির ভাত যখন খাই তখনতো আর দেখিতে যাওয়া ঠিক নহে । তাহার মনে পড়িল এই চন্দ্রকান্তই একদিন তাহার বধূকে চুলের মুঠি ধরিয়া থাপ্পড় মারিয়াছিলেন , যদিও সেদিনের রন্ধনে অতিরিক্ত লবন হইবার পশ্চাতে চন্দ্রকান্তর বধূরেই ভূমিকা ছিল , কিন্তু তিনি তাহা বিশ্বাস করেন নাই , মহিম বুঝিয়াছিলেন ইহা পৃথক হইবার অজুহাত । সেইদিন হইতেই ভাতের হাঁড়ি পৃথক হইয়াছে ।
হঠাৎ চন্দ্রকান্তের ফোন বাজিয়া উঠিল । তিনি কঞ্চিটি ফেলিয়া ফোন ধরিয়া উঠানের এক কোনায় গিয়া কথা বলিতে লাগিলেন । তাহার ফোনের কথোপকথনের মধ্যে একটি কথা শোনা গেল , ” আগামী ২২ এ বৈশাখ দিনটি ভালো আছে , রায়চকের মহামায়া মন্দিরে ……। ” বাকি কথোপকথন শ্রুত হইল না । চন্দ্রকান্ত উঠান ছাড়িয়া পূবের মাঠের দিকে চলিয়া গেলেন।

সকাল হইতেই পিতা গৃহে অনুপস্থিত রহিয়াছিলেন । অদ্য কালাচাঁদের গৃহে উনুন জ্বলে নাই । প্রাতে জল সহযোগে কয়েকটা মুড়ি খাইয়া কালাচাঁদ সেই যে তখন হইতে সুখী গাভীর বাছুরটির সহিত খেলায় মতিয়াছে এখনো তাহা ভাঙে নাই । সূর্যদেব শিরের উপর বিরাজ করিতেছেন । কালাচাঁদের আপন মস্তকের ছায়া তাহার পদযুগলের নিকট দৃশ্য হইতেছে । তাহার কাকিমা সকাল হইতেই দেখিয়াছেন যে সে উঠানে খেলিতেছে এবং তাহার নিকটে আসিলে তাহার পিতা চন্দ্রকান্ত কটু কথা শুনাইতে পারেন ইহা ভাবিয়া আসিতে সাহস করেন নাই । এক্ষনে কালাচাঁদকে উঠানে দেখিয়া তিনি নিশ্চিত হইয়াছেন তাহার পিতা গৃহে নাই । যদি থাকিতেন তাহা হইলে কালাচাঁদের খেলা সমাপ্ত হইত । তিনি তাহার নিকটে আসিয়া বলিলেন , ” বাবা চান করেছিস । ” কাকিমার গলা পাইয়া তাহার খেলা ভাঙিল । সে বাছুরটিকে ছাড়িয়া দিয়া কাকিমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল , ‘ না । ‘ তাহার কাকিমা বলিলেন , ” চল বাছা , চান করে খেয়ে নিবি । ” কালাচাঁদ কাকিমার হাত ধরিয়া উঠান ত্যাগ করিল।

সন্ধ্যা নামিল । পাখিরা আপন বাসায় ফিরিতে লাগিল । চন্দ্রকান্ত , সুকন্যাকে লইয়া গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন , মেঝের মধ্যখানটিতে একটি চট পাতিয়া বই খুলিয়া কালাচাঁদ পড়িতেছে, ” ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায়রা ….। ” তাহার পিতার সহিত এক রমনীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কালাচাঁদের জমিদার হইয়া পায়রা পুষিবার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হইয়া গেল । চন্দ্রকান্ত , সুকন্যার প্রতি কালাচাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে তাহাকে বলিলেন , ” এ হলো তোর নতুন মা । ” কালাচাঁদ চাহিয়া দেখিল কিন্তু নিরুত্তর রহিল । সে কিছুতেই তাহার মাতার স্থলে অন্য কাউকে বসাইতে পারিল না । সুকন্যাও তাহাকে পুত্র বলিয়া মানিয়া লইতে বিশেষ আগ্রহ দেখাইলেন না । কালাচাঁদ এবং সুকন্যার পারস্পরিক অনাগ্রহ দেখিয়া চন্দ্রকান্ত বুঝিলেন , জোরপূর্বক গাধাকে পিটাইয়া ঘোড়া বানানো যায় না । তিনি একটি খাটিয়ায় বসিয়া, সুকন্যাকে ডাকিয়া বলিলেন , ” সু , তুমিও বসো । ” কালাচাঁদ সেইস্থল হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া উঠানে আসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল । চন্দ্রকান্ত বারকয়েক ডাকিয়া তাহার গলা না পাইয়া বলিলেন , ” আপদ গেল । ” কালাচাঁদ উঠান হইতে পিতার কথাটি শুনিতে পাইল । তাহার শিশুমন হয়তো বুঝিল এখানে থাকা অনাবশ্যক তাই সে গৃহের নিকটস্থ মাঠ পার হইয়া বড় রাস্তা ধরিল । অনেক রাত্রি পর্যন্ত ফিরিয়া না আসিলেও চন্দ্রকান্ত তাহার পুত্রের খোঁজ করা আবশ্যক মনে করিলেন না । আপদ বিদাই হইয়াছে ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।

বাইশ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে । সেইদিনের সেই ছোট্ট কালাচাঁদ বর্তমানে কালু মস্তান হইয়াছে । সেইদিন রাস্তা হইতে তুলিয়া আনিয়া ডাকাতের সর্দার বিলু তাহাকে আশ্রয় দিয়া বড় করিয়া তুলিয়াছে । তাহারই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বয়স ভারাক্রান্ত বিলুর সমস্ত অসামাজিক কর্মের দায়িত্ব কালু আপন স্কন্ধে লইয়াছে । অদ্য ব্যাংক ডাকাতি করিয়া বিস্তর অর্থ লইয়া আসিয়া বৃদ্ধ বিলুর নিকট দিতেই , বিলু খুশি হইয়া সকল সদস্যদের তাহা বিলাইয়া দিয়া আপন ভাগের অর্থ পুরস্কার স্বরূপ কালুর হস্তে তুলিয়া দিয়া বলিল , ” এই টাকা তোর । ”
কালু পূর্বে বহু ডাকাতি করিয়াছে কিন্তু এই ধরনের বড় ডাকাতি এই প্রথম । অনেকগুলি টাকা হাতে পাইয়া সে ভাবিতে বসিল , এই টাকা লইয়া কি করিবে ? সে দেওয়ালে টাঙানো বৃহৎ আরশিটিতে তাহার প্রতিবিম্ব দেখিতে লাগিল । পশ্চাৎ হইতে একটি কন্ঠ শুনিয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল তাহার সহকর্মী ভোলা তাহাকে ডাকিতেছে । সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া তাহাকে কাছে ডাকিতেই সে নিকটে আসিয়া বলিল , ” রানু মাসির কাছে খবর পেলাম নতুন আমদানি হয়েছে , এই প্রথম সে এই লাইনে এসেছে , যাবি নাকি ? ” যদিও ইহার আগে সে এই পথ মাড়ায় নাই , কিন্তু সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে । ভোলার কথা শুনিয়া এবং নিজের পকেটে বিপুল অর্থ দেখিয়া সে রাজি হইল ।
উদ্যেশ্যস্থলে পৌঁছাইয়া কালু দেখিল , বিজলী বাতির ম্লান আলোকে অনেকগুলি ঝুপড়ি দেখা যাইতেছে ; তাহারেই একটির দরজার নিকট গিয়া ভোলা মৃদুস্বরে ডাকিল , ” রানু মাসি আছো নাকি ? ” তাহার ডাকে ঝুপড়ির দরজা খুলিয়া একজন মধ্যবয়সী মহিলা বাহির হইয়া আসিল । ভোলা, কালুকে দেখাইয়া তাহাকে বলিল , ” এ হলো আমার বন্ধু । অনেক বলে কয়ে আজ নিয়ে এলাম । সেই নতুনটি কোথায় ? ” রানু মাসি একটি দরজার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল । ভোলা , কালুকে বলিল, ” যা ঐ ঘরে ঢুকে পড় । ” কালু পূর্বে এই ব্যাপারে অভ্যস্থ নয় বলিয়া ইতস্তত করিতে লাগিল । রানু মাসি তাহা দেখিয়া বলিল , ” এ ভোলা এ তুই কাকে লিয়ে আলি । এ ছোড়া তো দেখছি ম্যাইয়া ।” রানু মাসির কথা কালুর কানে বিঁধিল , তাহার পুরুষত্ব লইয়া ঠাট্টা শুনিয়া সে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাইয়া দরজা ঠেলিয়া ঢুকিয়া দেখিল , ঘরে একটি নীল বাতি জ্বলিতেছে । একটি রমনী সাজিয়া গুজিয়া তক্তার উপর বসিয়া রহিয়াছে । ব্যাঘ্রের আক্রমন নিকটে দেখিয়া সেই রমনী হু-হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল । তাহার কান্না দেখিয়া কালুর অন্তর ব্যথিত হইল । সে ইহা দেখিয়া অনুভব করিল তাহার হৃদয়ে শৈশবে যে মনুষ্যত্ব রহিয়াছিল তাহা এখনো টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছে । কালু সেই রমনীর নিকট গিয়া বলিল , ” তুমি কাঁদছো কেন ? ” রমনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল , ” আমি কখনো ভাবিনি যে এই পথে আসতে হবে , ভাগ্য আমাকে এই পথে নিয়ে এলো । ” কালু উৎসুক হইয়া বলিল , ” কেন ? যদি কিছু মনে না কর আমাকে খুলে বলো । ” কালুর কথায় রমনীটি কি ভরসা পাইল তাহা আমি অজ্ঞাত , তাহার জীবনের আদ্যপ্রান্ত বলিতে শুরু করিল । দুইজনের গল্প শেষ হইতে চাহে না । ভোর হইয়া আসিল , ভোলা দরজা ঠেলিয়া বলিল , ” কইরে কালু যাবি না । ” ঘরের অভ্যন্তর হইতে উত্তর আসিল , ” আর কিছুক্ষণ দাঁড়া ।” কালু পকেট হইতে একটা পাঁচশত টাকার নোটের বান্ডিল বাহির করিয়া , রমনীর উদ্যেশ্যে বলিল , ” এই নাও হেনা , তোমার বাবার চিকিৎষা করাও । ” কালাচাঁদ উঠিয়া দাঁড়াইল , হেনা তাহাকে প্রনাম করিয়া বলিল , ” তুমি আমার দেবতা । আমার বাড়ি যেও । ” কালাচাঁদ না চাহিলেও হেনা জোরপূর্বক তাহার গালে একটি ভালোবাসার মুহূর্ত আঁকিয়া দিল । কালাচাঁদ বলিল , ” আর তুমি এখানে আসবে না । আমি থাকতে এভাবে তুমি নিজেকে বিক্রি করবে না । আজ আসি , কাল তোমার ঠিকানায় পৌঁছে যাবো । ” কালাচাঁদ দরজা খুলিয়া চলিয়া গেল । হেনা ঠাকুরের উদ্যেশ্যে প্রণাম করিয়া বলিল , ” ঠাকুর তুমি অপার করুনাময় , তোমার আরাধনা আজ সফল হলো । ”

সকাল হইতেই হেনা বারংবার দরজা দিয়া নিকটস্থ পথের পানে দেখিতেছে । অবশেষে তাহার প্রতীক্ষার অবসান হইল । তাহার ভালবাসার মানুষটি দৃশ্য হইল । হেনা ছুটিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িতে সকাল ১০ টা বাজিয়াছে । হেনার ঘরে ঢুকিয়া কালু দেখিল , একজন হাড় জিরজিরে ব্যক্তি খাটিয়ায় শুইয়া রহিয়াছেন । কালুর বুঝিতে অসুবিধা হইল না যে ইনিই হেনার পিতা । তাহাকে নিকটে ডাকিয়া হেনার পিতা বলিলেন , ” বাবা একবছর বন্যায় আমার ঘরবাড়ি সকলই ভেসে যায় । সেই বান হেনার মা কেও নিয়ে যায় । আমি ছোট্ট হেনাকে বুকে করে নিয়ে এখানে চলে আসি । হেনার মুখ থেকে তোমার কথা শুনে আমি শান্তি পাই । ” হেনা কালুর জন্য জল এবং চা লইয়া আসিল । কালু তাহা তাহার হাত হইতে লইল । বৃদ্ধ বলিতে লাগিলেন , ” বাবা এই বৃদ্ধের একটি কথা রাখো , তুমি পাপের পথ থেকে ফিরে হেনাকে নিয়ে সুখে সংসার করো । ” কালু সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িল । হেনা লজ্জিতা হইয়া দূরে সরিয়া গেল । কালু বৃদ্ধের নিকট হইতে উঠিয়া হেনার নিকট গিয়া বলিল , ” হেনা , তোমার বাবাকে ডাক্তার দেখিয়েছো ? ” হেনা বলিল , ” হ্যাঁ । ” কালু বৃদ্ধের নিকট বিদাই লইয়া , হেনার মুখপানে চাহিয়া বলিল, ‘ আজ আসি। ‘

তিন-চার দিন অতিবাহিত হইয়াছে । কালু , বিলুর পার্শ্বে বসিয়া রহিয়াছে । অপরাহ্নের অন্তিম সূর্য অস্তমুখি হইয়াছেন । হেনা কাঁদিতে কাঁদিতে বিলুর আড্ডায় প্রবেশ করিল । তাহাকে দেখিয়া কালু উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল , ” কি হয়েছে হেনা ? ” সে পূর্ববৎ কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ” বাবা ……..। ” কথার অবশিষ্টাংশটি সে আর বলিতে পারিল না । তাহার কন্ঠ শোকে জড়াইয়া গেল । কালু বলিল , ” চল , আমি যাচ্ছি । ” যাইবার পূর্বে সে বিলুকে উদ্যেশ্য করিয়া বলিল , ” আমাকে ক্ষমা করো , আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারবো না । আমার এখন অনেক কাজ । তোমার উপকারের প্রতিদান পেয়ে গেছো । ” কালুর মুখ হইতে উক্ত কথা শুনিয়া বিলু বলিল , ” বেইমান , শেষে কিনা অন্নদাতাকে ছেড়ে যাবি । সেদিন তোকে রাস্তা থেকে তুলে এনে কি ঐ মেয়েটা মানুষ করেছিল ? ” কালু বলিল , ” মানুষ তো করোনি বরং অমানুষ করেছো । আমার জায়গায় তোমার নিজের ছেলে হলে কি ডাকাত মস্তান বানাতে পারতে ? আমাকে তুমি ব্যবহার করেছো । ” কালুর তীব্র বাক্যবানের নিকট বিলু হার মানিল । কোথা হইতে তাহার সুবিবেকের উদয় হইল , তাহার স্বর পরিবর্তীত হইল । সে বলিল , ” আমার তো ছেলেই রইল না , সে বোধ হয় আমাকে বাবা বলে মেনে নিতে পারল না । তাই হয়তো জন্মের মুহূর্তে হাসপাতালে তার মায়ের সঙ্গেই আমাকে ছেড়ে গেল । ঠিক আছে যা সুখে সংসার কর । মাঝে মাঝে এসে এই বুড়োকে দেখে যাস । ” ” তোমার কথা মনে রাখবো ” বলিয়া হেনার হাত ধরিয়া কালু বাহির হইয়া গেল ।
হেনার গৃহে পৌঁছাইয়া কালু দেখিল , বৃদ্ধের নিথর দেহটা খাটিয়ায় পড়িয়া আছে । সে নিকটবর্তী কিছু লোক জোগাড় করিয়া শব দেহ লইয়া শ্মশান অভিমুখে চলিল । হেনা কাঁদিতে কাঁদিতে তাহার পশ্চাৎ অনুসরন করিল । কিছুদূর গিয়া কালু দেখিল হেনা পশ্চাতে আসিতেছে । কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহার চক্ষু যুগল লাল হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে ।হেনার পিতার সৎকার সমাপন হইতেই কালু হেনার হাত ধরিয়া বলিল , ‘ চল । ‘

হেনাকে সাথে করিয়া কালু যখন আপন জন্মভিটায় আসিয়া উপস্হিত হইল তখন মধ্যাহ্নের সূর্য অল্প পশ্চিমে ঝুঁকিয়াছে । ঘরে ঢুকিয়া কালু দেখিল তাহার পিতা খাটিয়ায় শুইয়া রহিয়াছেন । অস্থি নির্গত-চক্ষু কোটরাগত তাহার শরীর দেখিয়া কালু বুঝিল দীর্ঘ অনাহার তাহার পিতার শরীরে প্রভাব বিস্তার করিয়াছে । তাহাকে দেখিয়া চন্দ্রকান্ত বলিলেন , ” বাবা কালাচাঁদ এসেছিস ! ” তাহার চক্ষুর কোটর উছলাইয়া অশ্রু নির্গত হইল । কালাচাঁদ বলিল , ” বাবা , সেই মহিলা কোথায় ? ” চন্দ্রকান্ত বলিলেন , ” সে একমাসও এই ঘরে থাকেনি , অভাবের বাতাস দেখে চলে গেছে । ” কালাচাঁদ আর কিছু জানিতে চাহিল না । চন্দ্রকান্ত হেনার প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” এ কি আমার পুত্র বধূ ? ” কালাচাঁদ সম্মতি প্রকাশ করিতে ঘাড় নাড়িল । সে পিতার জীর্ণ চেহারার প্রতি চাহিয়া ভাবিল , তাহার জীবন যখন জোয়ারের জলে উপর দিকে উছলাইয়া উঠিতেছে পিতার জীবন তখন ভাঁটার টানে সমুদ্রের অতলে বিলীন হইবার জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিয়াছে । সে হেনার প্রতি চাহিয়া বলিল , ” বাবাকে প্রণাম করো । ” হেনা শ্বশুরকে প্রণাম করিল । চন্দ্রকান্ত কালাচাঁদকে বলিলেন , ” বাবা , আমাকে ধরে নিয়ে ঐ পুরানো সিন্দুকটার কাছে চলতো । ” কালাচাঁদ পিতার নির্দেশ মান্য করিল । তিনি পুত্রকে সিন্দুক খুলিতে বলিলেন । কালাচাঁদ সেটি খুলিতেই তাহার পিতা তাহার মধ্যে ঝুঁকিয়া একটি লাল বর্নের শালুর পুটুলি বাহির করিয়া বলিলেন , ” বৌমা এদিকে এসো । ” হেনা তাহার সম্মুখীন হইতেই সেই পুটুলিটি তাহার হাতে দিয়া বলিলেন , ” আজ থেকে এগুলো তোমার । আমার মা তোমার শ্বাশুড়ীকে দিয়ে গেছিলেন । তোমার শ্বাশুড়ী তো বেঁচে নেই তাই তার কাজ আমাকেই করতে হলো । ” হেনা শ্বশুরের হাত হইতে পুটুলিটি লইয়া পুনরায় সিন্দুকে রাখিয়া দিল । চন্দ্রকান্ত হেনার মুখের প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” আমার তো মা দিন গুনতিতে পড়েছে । আমি ভাঁটার টানে হারিয়ে যাবো । তোমারা তখন জোয়ারের জলে চান করতে ভুলো না । ” কথাটি শেষ হইতেই চন্দ্রকান্ত বুকে হাত রাখিয়া বসিয়া পড়িলেন । ঊর্ধপানে মুখ করিয়া অস্ফুটে বলিলেন , ” বাবা কালাচাঁদ , ঐদেখ স্বর্গ থেকে তোর মা আমাকে ডাকছে । ” কালাচাঁদ তাৎক্ষণিক জ্ঞান শূন্য হইয়া ‘ ডাক্তার- ডাক্তার ‘ বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল , কিন্তু তাহার পিতার খড়ের চালা গৃহে কোনো ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটিল না ।

Loading

One thought on “জোয়ার ভাঁটা

Leave A Comment